সরকারী কাজে আমাদের বাড়ীটা হুকুম দখল হয়ে যাওয়ার পর বছর পাঁচেক আমরা নিজস্ব ঘর বাড়ীহীন কাটিয়েছি। শেষ দুই বছর খিলক্ষেতে ফুফুর বাড়ীতে ছিলাম। বাবা এখানে ওখানে বাড়ী দেখে বেড়ান- কোন বাড়ীই আর পছন্দ হয় না। যেখানেই বাড়ী দেখতে যান- দিন শেষে একটা খুত, একটা অপছন্দের খবর নিয়ে ফিরে আসেন।
অবশেষে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের বছর পরিবারের সবার প্রতীক্ষার প্রহর গোণা শেষ করে বাবার একটা বাড়ী পছন্দ হয়। সবাই খুব খুশি। আমি তখন ছোট আমার খুশি সবার চেয়ে বেশি। আমি নেচে, গেয়ে, লাফিয়ে ঝাপিয়ে এক শেষ করে ফেলি। সেদিন রাতে বাবা ঘুমিয়েছিলেন নাকী জানি না। তবে আমি ঘুমানোর আগ পর্যন্ত দেখেছি বাবা মাকে, ফুফুকে, আমার ফুফাতো ভাই বোনদেরকে নতুন বাড়ীর গল্প শোনাচ্ছেন।
দিন কয়েকের মধ্যেই বিশাল একটা নৌকায় করে আমরা নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ফুফু খুব করে কাঁদলেন, সাথে ফুফাতো ভাই বোনেরাও। সব কিছুকে বিগত করে দাঁড় টানা নৌকাটি একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যায়।
ছবির মত সুন্দর এক একটা গ্রাম পাড়ি দিয়ে নৌকা এগিয়ে চলে। কচুরিপানায় বসে থাকা লাল, সাদা বকেরা বোকা বোকা চোখে নৌকার দিকে তাকিয়ে থাকে। শাপলা ফুলের ঘ্রাণে মন জুড়িয়ে যায়। শাপলার জন্য বায়না ধরি। মা মুঠো ভরতি শাপলা তুলে দেয়। সাথে সবুজ মত কিছু একটা, শাপলার ফল- ‘ভেট’। পরে অবশ্য নিজেদের বিলের ভেটের মেলা মুড়ি, মোয়া খেয়ে নিজেকে তৃপ্ত করেছি। আমাদের এলাকায় বেশ কয়েক প্রজাতির শাপলা ছিল। সাদা শাপলা- হাঁটু পানি থেকে শুরু করে দশ বার হাত পানিতে জন্মায়। পাতলা আবরণ ছাড়িয়ে কাঁচা খাওয়া যায়, বেশ সুমিষ্ট। মাছ দিয়ে তরকারী হিসেবেও বেশ। সাদা শাপলা আরও একটি আছে- এর ফুলে সাদার সাথে একটি বেগুনি আভা থাকে,ফুলের গন্ধ মোহনীয়। এটি অপেক্ষাকৃত কম পানিতে জন্মায়। টকটকে গোলাপি লাল আর এক প্রজাতির শাপলা পাওয়া যেত- এরাও তিন চার হাত পানিতে জন্মায়, এদের পাতা আকারে বেশ বড় হয়, ফল বা ভেট হয় না। ফুল পরিণত হওয়ার পর পচে নষ্ট হয়ে যায়।
সেদিন নতুন বাড়ি যেতে যেতে আমি আরও একটি জলজ ফলের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম যার স্থানীয় নাম- সিঙরা। ছোট ছোট পাতার লতানো গাছে পাতার গোঁড়ায় গোঁড়ায় ফল ধরে। দেখতে অনেকটা সিঙ্গারার মত- আকারে পানি ফলের চেয়েও ছোট। দুমাথায় বেশ সুচালো দুটি কাঁটা থাকে- শুকনা মওসুমে এদের জন্য বোরো ক্ষেতে কাজ করা ছিল প্রায় দুষ্কর।
বেশ কিছু খাল বিল আর তুরাগ, চিলাই নদী পার হয়ে খিলখেত থেকে গাজীপুরের পুবাইলের ছোট্ট একটা গ্রামে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন রাত হয়ে গেছে। সূর্যের আলোকে রাতের আঁধার চাদরে ঢেকে ফেলেছে। খুব আনন্দময় স্মৃতি বিজড়িত সেদিনটির কথা হৃদয় পটে এখনও জীবন্ত হয়ে আছে।
আনন্দঘন সেই ভ্রমণটায় একটা জিনিস দেখে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম- আমাদের নৌকা যখন তুরাগ আর চিলাই নদীর উপর দিয়ে যাচ্ছিল তখন নৌকার চারপাশে ‘ভুস’ করে করে প্রচুর শুশুক ভেসে উঠছিল। পানি থেকে ভেসে উঠা অদ্ভুত চেহারার এই প্রাণীটা কোনদিনই আমার ভাল লাগেনি। কিন্তু আজকে অনেক হারিয়ে যাওয়ার মাঝে যখন দেখি তুরাগ আর চিলাই নদী মাছ শূন্য, শুশুক শূন্য তখন বেশ একটা কষ্ট বুকে বাজে।
বাবার পছন্দ করা বাড়ীটা, গ্রামটা সত্যি সত্যি আমারও খুব পছন্দ হয়ে গেল। নাই বলতে যেন কিছু নেই সেই বাড়িতে, সেই গ্রামে। বাড়িতে আম, জাম, আনারস, কাঁঠাল, কলা সব আছে। এমনকি জঙ্গল ভর্তি ফল, মূলে। সকাল বেলা গাব গাছে পাকা গাব এক ডালে বুলবুলিতে খেয়েছে তো অন্য ডালে বসে আমি খেয়েছি। বন ডালিম খেয়ে জিহবা উলটিয়ে দেখেছি কতটা নীল হয়েছে। ফাগুন চৈত্রের কড়া রোদে পাকা বেত ফল একটু লবন দিয়ে খেতেও অমৃত স্বাদ লাগত। চাউলাগুড়ির রক্ত বর্ণ রসের টক স্বাদ নিতে চাইত না এমন কিশোরী, যুবতী খুজে পাওয়া ভার। বঁইচি, পেলা এমনকি দাঁত মাঝার জন্য বিখ্যাত মটকিলার পাকা ফলও সবার প্রিয় ছিল। এরকম নাম জানা, না জানা কত যে জংলা ফল নির্ভয়ে খেয়েছি- আজ কাল যখন গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে আঙ্গুরটা, আপেলটা কিনে খেতেও ‘বিষ’ খেয়ে মরার ভয় হয় তখন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সে সব অমূল্য দানের কথা এমনিতেই মনে পড়ে।
নতুন বাড়িতে যাওয়ার পর সেই গ্রামের একটা ছেলেও খুব কম সময়ে আমার বন্ধু হয়ে গেল। ওর নাম রঞ্জু। রঞ্জু আর আমি এক স্কুলে এক সাথে লেখা পড়া করেছি। ক্লাস নাইনে উঠে অবশ্য একটু দো- ডালা মত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি গেলাম বিজ্ঞান বিভাগে আর রঞ্জু গেল বানিজ্যে।
পুবাইল এলাকাটি যেন একটি মিনি পার্বত্য এলাকা ছিল। উপরের চালা জমিগুলি পাহাড়ের মত বেশ উঁচু- সুন্দর ক্রমশঃ ঢালু হয়ে আঁকাবাঁকা গভীর বিলের সাথে গিয়ে মিশে ছিল। চালা জমি জুড়ে ছিল বিস্তীর্ণ আনারসের বাগান। বিশাল বিশাল আনারসের বাগানের মাঝে ফাঁকা ফাঁকা দু একটা ঘর বাড়ি ছিল, বাড়ি ঘর ঘিরে আম কাঁঠালের প্রচুর গাছ। এই সব আনারসের বাগান ঘিরে কত প্রজাতির জংলা গাছপালা, লতা, গুল্ম , ফুল ফলের গাছ যে ছিল তার হিসেব দেয়া অসাধ্য! আনারসের বাগানে বাস করত শিয়াল, সজারু, খরগোশ, বিশাল আকারের অজগর, জাত সাপ, দাঁড়াশ, নানা প্রজাতির ছোট ছোট সাপ আরও নানা জাতের বন্য প্রাণী।
বিলের এক কলসি জল মাছ শুন্য ছিল না- বললে খুব বেশি বলা হবে না। আগুন পৌষ মাসে সকাল বিকালে লোকজন যখন তাদের মরিচ গাছে, কপি গাছে পানি দিত মন খারাপ করে বসে বসে প্রতিটি গাছের গোঁড়ায় ছোট ছোট চিংড়ি, পুঁটি, রঙ্গিন চাঁদার ছটফট করে মরার দৃশ্য দেখতাম।
মাছ শুধু উদরপূর্তি বা মানুষের আমিষেরই যোগানদাতা ছিল না- নির্মল, নিষ্পাপ বিনোদনেরও উপাদান ছিল। বর্ষার পানিতে ডুবে থাকা হিজল গাছ যেন গজার মাছের বন্ধু ছিল। প্রত্যেক হিজল গাছের গোঁড়ায় দুচার পাঁচটা গজার মাছকে সব সময়ই দেখা গেছে খুনসুটি করছে। আমি আর রঞ্জু বিকেলে মাছ বিচরণ করে এমন সব জায়গায় বসে বসে মাছের খেলা দেখতাম। ঝাঁকে ঝাঁকে পুঁটিদের রুপালী নাচন, বোকা বোকা চেহারার মেনি মাছ, বাইল্যা মাছ, টাকি মাছের ঘাপটি মেরে বসে থাকা, এর মাঝখান দিয়ে প্রকাণ্ড বোয়ালের গোঁফ নেড়ে চলে যাওয়া কিংবা একটা কাইক্কা মাছের ছুটে এসে ঝাঁক থেকে একটা পুঁটি সুচালো ঠোঁটের ডগায় নিয়ে তীব্র বেগে ছুটে যাওয়া খুব করে উপভোগ করতাম।
আমরা দুজনও প্রচুর মাছ ধরতাম। হেন কোন মাছ ধরার পন্থা নাই যা আমার আর রঞ্জুর জানা ছিল না। মা মাঝে মধ্যে মাছ কুটতে কুটতে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বটি উচিয়ে তেড়ে আসত কিন্তু মায়ের দাবড়ানি খেয়েও খান্ত হতাম না- মাছ ধরার নেশা বড় কঠিন নেশা!
আমন ধান কাটার পর শুকনা নারায় আগুন দিলে ধান খেতের ফড়িং, পোকামাকড়, আগুনে পোড়া ধানের খই খেতে ফিঙ্গে, দোয়েল, শালিক নানা প্রজাতির শত শত পাখি উড়ে আসত- এমনি সব মনোমুগ্ধকর নানা দিন গুলির মধ্য দিয়ে আমি আর রঞ্জু একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলাম।
দিনে দিনে রঞ্জুর সাথে আমার আত্মার একটা সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে উঠেছিল। ও ছিল হিন্দু আর আমি মুসলমান, আমি কৃষ্ণকায় ও ছিল কাঞ্চন বর্ণ! আমি ছিলাম ভীতুর ডিম আর রঞ্জু খুব সাহসী! এলাকায় কোন লোক মারা যাওয়ার খবর শুনলে আমি ঘর থেকেই বের হতাম না। প্রচণ্ড গরমের রাতেও কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকতাম। অন্ধকার এবং মৃত্যু দুটোতেই আমার খুব ভয়। রঞ্জুর ভয় বলতে কিছুই ছিল না এলাকায় কোন হিন্দু লোক মারা গেলে সেটা দিন হোক আর রাত হোক রঞ্জু চিতায় একাই একশ ছিল।
আমার মৃত্যু ভয় সম্পর্কে একদিন ও আমাকে হাসতে হাসতে বলেছিল- তুই কখনও মরবি না? আমি আশীর্বাদ করি ভগবান তোকে যেন পরমায়ু দেয়! কিন্তু মুশকিল কি জানিস? বার্ধক্য অভিশাপ রে! শরীর এক সময় রোগ বালাইয়ের ডিপো হয়ে যায়।
আমার বয়সের সূর্যটা এখন পশ্ছিম আকাশে ঢলে গেছে। রঞ্জুর সেই কথাটা খুব মনে পড়ে আজকাল। আল্লাকে বলি- পরমায়ু চাই না। নীরোগ, সুস্থ একটা জীবন চাই- সেটা যদি অল্পদিনের হয় তাও কবুল!
রঞ্জুর খুব সাহস ছিল বলেই ও অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করে বেড়াত। আমি ছিলাম ওর বিপরীত। আমার না ছিল সাহস, না রূপ। তখন ক্লাশ টেনে উঠেছি রঞ্জু একদিন খুব সকালে এসে বলল- আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হবি কিন্তু!
আমি যা বোঝার বুঝে ফেললাম। সুবোধ ছেলের মত বই খাতা নিয়ে আগে ভাগেই বের হয়ে গেলাম। পথে গিয়ে রঞ্জু আমার হাতের বইগুলি নিয়ে নির্জন জঙ্গলে লুকিয়ে বলল- চল।
আমি কিছু না বলে ওর পিছে হাঁটা দিলাম। চার মাইল হাঁটলাম তারপর দশ মাইল বাসে চড়ে ও আমাকে নিয়ে একটা কলেজের মাঠের এক কোণায় একটা মস্ত আম গাছের নীচে হাজির হল। বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখলাম একটা দশা সই চেহারার মেয়ে মাঠ পাড়ি দিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ভয়ে আমার বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল, আমি রঞ্জুর হাত থেকে আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিপরীত দিকে এমন করে হাঁটা দিলাম যেন আমি ওকে চিনিই না!
নিরাপদ আর যুত সই একটা জায়গায় গিয়ে আমি রঞ্জুর কপালে কি ঘটেছে দেখার জন্য সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম- মেয়েটা আমার ভয়কে অমূলক প্রমাণ করে ওর সাথে হাস্য রসে মেতে উঠেছে। নিজেকে বড় বোকা মনে হতে লাগল। ভেবে দেখলাম ওদের কাছে ফিরে যাওয়াটা হবে লজ্জা জনক। এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে এক সময় মনে হল- আমি যেন একটা সদকার ছাগল!
ঘণ্টা দুই কাটিয়ে এসে আমার এক হাত নেয়ার বিন্দু মাত্র সুযোগ না দিয়েই ও ব্যস্ত ভাবে আমাকে বলল- এই তুই কিরে?
আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল, আমি চিৎকার করে বললাম- আমি কিরে মানে?
রঞ্জু আমার রাগ বুঝতে পেরে নরম গলায় বলল- না, মানে বলছিলাম তুই অমন করলি কেন?
আমি আমার ভয়ের কথাটা দিব্যি চেপে গিয়ে বললাম- অমন করেছি মানে? শালা রাম ছাগল, তুই খালার বয়সী মেয়ের সাথে প্রেম করবি আর আমি এখানে নাচব?
রঞ্জুর অনেক প্রেমের মাঝে একটা বিখ্যাত প্রেম ছিল আমাদের পাশের গ্রামেরই এক মেয়ের সাথে। মেয়েটার নাম ছিল- বন্যা। আমরা তিন জনই একই সাথে একই ক্লাসে পড়তাম। রঞ্জুর সব প্রেম স্বল্প মেয়াদী হলেও বন্যার সাথে প্রেমটা ছিল বহু বছর- অমলিন, অটুট।
রঞ্জুর বাবা ছিল কাঠ খোট্টা ধরণের কর্কশ মেজাজের মানুষ। অন্য দিকে আমার বাবা আবার বেশ উদার প্রকৃতির ছিলেন। আমার এই সুযোগটার জন্য রঞ্জু আর বন্যার প্রেমের অনেক কিছু আমাকে সামলাতে হত। চিঠি প্ত্র আনা নেয়া, বিশেষ বিশেষ দিনে উপহার কিনে দেয়া ইত্যাদি। দেবদাস, শাপমোচন কিংবা মন কেমন করে বইটা কিনে আনার জন্য আমাকে মাইল ছয়েক পথ হেটে জেলা শহরে যেতে হত। কোন মতে জেলা শহরে যেতে পারলে আমি আবার তিনটা সিনেমা না দেখে ফিরতাম না। ঝুমুরে ‘নীল আকাশের নীচে’ তো চান্দনায় ‘অবুঝমন’ শেষে উল্কায় ‘অনেক প্রেম অনেক জ্বালা’ দেখে মাতালের মত টলতে টলতে বাড়ি ফিরতাম।
আজ তোকে শেষ করে ফেলব- বলে মা কোন দিন তেড়ে এলেও বাবা মাকে সামলে নিতেন। বাবা কি যে ভালবাসতেন! সে সময় বুঝতে না পারলেও আজ খুব করে বুঝতে পারি- বাবা আমাদেরকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাবেন বলেই অত ভালবাসতেন। স্কুলের শেষ ধাপটি পার হওয়ার আগেই এক শীতের সকালে বাবা চলে গেলেন।
কিছুই থেমে রইল না। ঘরে টাঙ্গানো ঘড়ির কাটা থেকে শুরু করে রঞ্জু বন্যার প্রেম সবই চলতে থাকল। আমিও চলতে চলতে একদিন ডিগ্রীতে ভর্তি হলাম।
রঞ্জুর প্রেমের সুত্র ধরেই বন্যাদের বাড়ীতে আমার যাতায়াত ছিল। বন্যার বাবা ওরা ছোট থাকতেই গিয়েছিলেন। কাজেই আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমার প্রতি বন্যাদের সহানুভুতিটুকুও যেন আরও গভীরতা পেয়েছিল। ঈদে, অন্যান্য ছোট খাট আচার অনুষ্ঠানে, কখনও এমনিতেই ওদের বাড়ীতে দাওয়াত করত। দাওয়াত ছাড়াও ওদের বাড়ীতে চলে যেতাম কখনও একা, কখনও সুযোগ পেলে রঞ্জুও আমার সাথে যেত।
একদিন বিকেলে বন্যাদের বাড়ি গেছি। ওইদিন ওদের বাড়ীতে ছোট্ট একটা সিনেমাটিক ঘটনা ঘটে গেল। বন্যার ছোট বোন পান্না টেবিলে আমাকে খাবার দিতে গিয়ে কিভাবে জানি প্রায় আমার উপরে পড়তে গিয়ে কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে লজ্জা রাঙা মুখে দৌড়ে পালিয়ে গেল। পড়তে পড়তে ও নিজেকে বাঁচাতে পারলেও ওর দীঘল কাল চুল বাঁচাতে পারেনি। চুলগুলি আমার মুখের উপর যেন আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। চুলের ঘ্রাণ আমাকে শক্তিহীন একটা জড় পদার্থে পরিণত করল। কিছুক্ষণ বসে থেকে আমি পান্নার হাসিমাখা মুখটা বার বার মনের আয়নায় দেখতে লাগলাম একসময় কাউকে কিছু না বলেই ওদের ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লাম।
দিন কয়েকের ছোট্ট মেয়েটা আমার কাছে এক লাফে যেন মস্ত কিছু একটা হয়ে উঠে। আমরা যখন স্কুলে পড়ি পান্না তখন ফ্রক পরা ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে! নিজের মাঝে আমি একটা ভাঙ্গাগড়া দেখি- পুরাতন আমির মাঝে একটা নতুন আমি যেন উঠে আসছে। দিন কয়েক খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হইনি- শুয়ে শুয়ে নানা চিন্তার চলচিত্র কল্পনা করেছি।
আগেই বলেছি, আমি বরাবরই একটা ভীতুর ডিম ছিলাম। তবু বেশ সাহস করে ঘন ঘন কয়েকদিন পান্নাদের বাড়ি যাই। পান্নাকে বুঝতে চেষ্টা করি। কিছুর ছুতায় কাঁপা হাতে একটু ছুঁয়ে দেয়া, এক টেবিলে বসলে আলতো করে পায়ের সাথে একটু পা ঠেকিয়ে দেয়া-সভ্যতা ভব্যতার নিকুচি করে আমি আসলে একটা সিগন্যাল পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। এই অপচেষ্টার কারণটা আরেকবার বলছি। যেহেতু আমার রূপ, লাবণ্য, সাহস কিছুই ছিল না সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই কারও সাথে আমার প্রেম হতে পারে এমন আত্মবিশ্বাসটাও ছিল না।
যাইহোক, বেশ কয়েকদিন চেষ্টা করেও আমি পান্নার ‘সিগন্যাল’ বুঝতে পারিনি। অবশেষে আর একটা সাহসী ভুমিকা নিয়ে ফেলি। একদিন ঘণ্টা দুয়েক চেষ্টা করে সুঁই দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাম হাতের মধ্যমার ডগায় ক্ষীণ একটা রক্তের ধারা বহাতে সমর্থ হই। রক্তের খুব অপচয় না হয়ে যায় তাই দ্রুত একটা শুভ্র কাগজে তিনটা শব্দ লিখে ফেলি- আই লাভ ইউ!
দুদিন রক্ত রঞ্জিত দুটি আই লাভ ইউ পাঠিয়েও পান্নার কোন প্রতি উত্তর না পেয়ে কলমের কালো কালিতে আরও একটা চিরকুট লিখে ফেলি- আঙ্গুলের রক্তে লেখা চিঠির জবাব দিলে না। তবে কি হৃদপিণ্ডের রক্তে চিঠি লিখে দিব?
তড়িৎ উত্তর আসে। রঙ্গিন কাগজটা হাতে নিয়ে আমি ঘেমে নেয়ে উঠি। মনে হয় পৃথিবীটা আমার হাতের মুঠোয়। নির্জন থেকে নির্জনতর স্থানে বসে আস্তে আস্তে কাগজের ভাঁজ খুলি- ‘এইটা আপনে কি করলেন? আমার কিছু ভাল লাগে না’।
‘সিগন্যাল’ পেয়ে আমি আনন্দে পাগলের মত নাচতে থাকি। আমার পায়ের নীচে শুকনা হরিতকির পাতারা ছম ছম সুর তোলে। লাজমাখা চোখে আমার দিকে স্থির তাকিয়ে থাকা বৃক্ষরাজি, লতা পাতার দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে মাথা নিচু করে বাড়ীর দিকে পা বাড়াই।
তিন শব্দের চিরকুট দ্রুত হাজার শব্দের প্রেম পত্রে রূপান্তরিত হয়। পৃথিবীটা আমার কাছে সত্যি কি যে রঙ্গিন হয়ে উঠে! সময়গুলি দ্রুত বয়ে যায়। এক সময় মনে পড়ে রঞ্জুকে ব্যপারটা না জানানোটা খুব অন্যায় হয়ে যাচ্ছে। ও হয়ত পরে খুব কষ্ট পাবে।
একদিন সন্ধ্যার আগে রঞ্জুদের বাড়ি গেলাম। তারপর ওদের বাড়ীর কাছে বিলের ধারে অনেক রাত অবধি আমরা আড্ডা দিলাম। কিন্তু কি জানি একটা লজ্জায় পান্না আর আমার প্রেমের কথাটা বলতে পারছিলাম না। অবশেষে এক সময় লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে একটু অন্য রকম করে কথাটা ওকে বলেই ফেললাম- দোস্ত, একটা কাজ করে ফেলেছি! ঐ যে, যে আদালতের উপরের দিকে তোর হৃদয় নিয়ে মামলার শুনানি চলছে। সে আদালতের নীচের দিকে ‘একা একা কেন ভাল লাগে না’ জানতে চেয়ে আমিও একটা রীট পিটিশন মেরে দিয়েছি রে।
চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম রঞ্জু আমার দিকে স্থির চোখে নির্বাক তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর সুন্দর হেসে নীরবতা ভেঙ্গে বলল- তুই পারলি? শেষ পর্যন্ত তুই পারলি? তাইত বলি! তাইত বলি রে...
আমি ওর অসম্পূর্ণ কথাটা জানার আগ্রহ বোধ করি। কিন্তু আমার আগ্রহকে বিন্দু মাত্র পাত্তা না দিয়ে ও বার বার ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কিছুক্ষণ পর পর একই কথা বলতে থাকে- তাইত বলি! তাইত বলি রে...
ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেলে এক সময় আমি দুহাতে সজোরে ওর জামার কলার চেপে ধরি। ও আমার হাত ছাড়াবার বৃথা চেষ্টা করে মিনমিনে গলায় কোন মতে বলে- না, মানে বেশ কিছু দিন ধরে খেয়াল করছি তোকে কেমন পুরুষ পুরুষ লাগছে রে!
আমি আমার হাতটা চট করে ওর গলা থেকে সরিয়ে নেই। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে নির্জন রাতের চারপাশটা দেখি ঐ রকম একটা কথা আর কেউ শুনছে নাতো! তারপর রঞ্জুকে পিছনে ফেলে রেখে হন হন করে বাড়ীর দিকে হাঁটা দেই।
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে আমি কি, কি ছিলাম, কি হয়েছি ইত্যাদি ভেবেছি। কিন্তু মাথা মুণ্ডু কিছুই স্থির করতে পারিনি। তবে আন্দাজ করতে পেরেছিলাম কিছু একটা হয়ে উঠছি- রঞ্জুদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ীর পথটুকুর মাঝখানে একটা বিশাল পুকুর ছিল। পুকুর পারে ছিল প্রকাণ্ড একটা গাব গাছ। দিনের বেলায়ও ওই গাছটার নীচে সূর্যের আলো পড়ত না। গাব গাছটায় নাকি একটা ভূত থাকত। অমাবস্যার রাতে অনেকই নাকি দেখেছে ভূতটা এক পা পুকুরে আর এক পা গাব গাছের উপর দিয়ে মাথাটা আকাশে তুলে দাড়িয়ে থাকত। আমি কখনও সন্ধ্যার পর একা ওই পথে যাইনি। রঞ্জু সব সময় আমাকে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেত। তো রঞ্জুর মুখ থেকে পুরুষ পুরুষ লাগার কথা শুনে ওই রাতেই আমি প্রথম নির্ভয়ে ঐ গাব গাছটার নীচ দিয়ে বাড়ি চলে এসেছিলাম!
সুখের আশায় প্রিয় গ্রামখানি ছেড়েছি বহুদিন- কতটুকু সুখী হয়েছি তা আজও বুঝে উঠতে পারি না। মাঝে মাঝে প্রিয় গ্রামটায় যাই- মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। প্রাক যৌবনে যখন নারী সৌন্দর্য একটু একটু বুঝতে শিখেছি কিন্তু যৌনতার কিছুই জানতাম না তখন একটা বাংলা সিনেমায় নায়িকাকে ধর্ষিতা হিসেবে দেখে ভয় পেয়েছিলাম। কাপড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, আলু থালু বেশ, বিধ্বস্ত চেহারা, শূন্য দৃষ্টি। আমার প্রিয় গ্রামটায় গেলে কেন জানি সিনেমায় দেখা সেই দৃশ্যটার কথা খুব খুব মনে পড়ে!
রঞ্জুও গ্রাম ছেড়েছে অনেক বছর। ওর সাথে দেখা হয় না। আমি গ্রামে যাই তো ও যায় না, ও যায় তো আমি যাই না। এমনি করেই চলছিল- বছর খানেক আগে ওর সাথে দেখা হয়ে গেল। খুব করে গল্প করলাম। একবার ওর কাছে জানতে চাইলাম- হ্যাঁরে, এখনও কবিতা লিখিস? বই পুস্তক পড়িস তো?
ও লাজুক হেসে বলল- আরে দূর! কি যা তা বলছিস। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেল- ও সব পাগলামির বয়স কি আর আছে রে?
একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রাখি। মনে মনে বলি- আমি এখনও বই ছাড়তে পারিনিরে। পারিনি বলেই হয়ত আমার প্রিয় গ্রামটার কথা, তোদের কথা ভুলতে পারি না। পান্নাকে এখনও হৃদয় অনামিকায় ধারণ করেই বেঁচে আছি!